লেখক : রোহান অর্পন
ত্রিশ মিনিট আগে ছোট মামার এক্সিডেন্ট হয়েছে। মোটরসাইকেলের সিলিন্ডারে পা লেগে পুড়ে গিয়েছে। তাও যেমন তেমন পোড়া নয়। উপর থেকে চামড়া ঝলসিয়ে গেছে। আসলে ছোট মামা নতুন চালক। গ্রাম্য ভাষায় যাকে বলি আনাড়ি চালক। আমার মা, খালা, খালু হসপিটালে এসে উপস্থিত হয়েছে। মা ও খালার মুখাবয়ব এমন যেন ছোট মামার বেশ বড় ধরণের ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। বড় ধরণের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আল্লাহর কৃপায় বেচে গেছে। খালুজানের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বরং চেহারায় বিরক্ত ভাব ফুটে ওঠেছে। খালু কে মানিয়েছে বেশ। হয়তোবা তিনিও বাইশ তেইশ বৎসরে এলোপাথাড়ি চলাফেরা করে মারা খেত। তাই তার কাছে বেশ স্বাভাবিক ব্যাপার মনে হচ্ছে। মামার পায়ে ড্রেসিং করানো শেষ, ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়েছে। ব্লিডিং বেশী হওয়ায় ডাক্তার সাহেব হাসপাতালে একদিন থাকার জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। আপ্যায়ন এর জন্য রয়েছে নিরামিষ এবং মুরগির স্যুপ। সাথে আছে সাদা রঙের পোষাক পরা সেবিকা দের বিশেষ সেবা। মা নিমন্ত্রণ গ্রহন করেছে বটে, কিন্তু মামা একা থাকতে রাজি নয়। বাড়ির সবচেয়ে বেহুদা সন্তান হওয়ায় আমাকে মামার সাথে থাকতে হলো। তাছাড়া মামার সাথে আমার বন্ধুত্ব বেশ জটিল। আর দু বছর আগে পৃথিবী তে ল্যান্ডিং করলেই মামা কে হাতেনাতে ধরতে পারি। তবুও এখনো মামার সাথে ভালোই জমে। আমাদের মামা ভাগনের বয়সের পার্থক্য চার বছরের। বাড়ির সবাই চলে গেলো। অচেনা এই হসপিটালে রয়ে গেলাম আমি আর মামা। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে মামা শুয়ে পড়লো। আমি রুম থেকে বেরুলাম হাটাহাটির জন্য। কেবিন থেকে বের হলে লম্বা বারান্দা। বারান্দার কোণায় জানালার পাশে এক নারী দাঁড়িয়ে আছে। নীল রঙের জামা পড়নে। চেহারা বোঝা যাচ্ছে না, আমি জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম। উনি চোখের কোণা দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। গাছ গুলো দুলে দুলে নৃত্য করছে মনে হচ্ছে। প্রচন্ড বাতাস। এতো বাতাসে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টসাধ্য। কিন্তু আমার পাশের মেয়ে টা বিনা অসুবিধায় দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষন পর আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, “এই পিচ্চি এতো রাতে বাহিরে কী?” আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে যাই। “ইয়ে মানে আমার ঘুম আসছে না, তাই বেরিয়ে একটু হাটাহাটি করছিলাম ” “আমি আসলে আরও দেড়িতে ঘুমাই ” নীল রঙের জামা পড়া অচেনা মেয়ে, “কীসে পড়ো?” ” ক্লাস টেন এ ” “আপনি?” “এইচ এস সি পরীক্ষা দিচ্ছি” আমার অনুমান কাছাকাছি গিয়েছে। ভেবেছিলাম ফার্স্ট ইয়ার অথবা সেকেন্ড ইয়ার এ পড়ে। এছড়া বাইরে বিদ্যুৎ চমকানোর পাশাপাশি আমার মাথায় ও ঠাডা পড়লো! একজন এইচ এস সি পরীক্ষার্থী রাত ১২ টার সময় হাসপাতালের বারান্দায় কি করে? “আপু বেয়াদবি মাফ করবেন, আপনার তো কাল পদার্থ বিজ্ঞান পরীক্ষা আছে! আপনি এখানে কী করেন? আপনার তো এখন টেবিলের সামনে ঢুলু ঢুলু চোখ নিয়ে বসে থাকার কথা!” “তুমি কী জানো আমি বিজ্ঞানে পড়ি নাকি ব্যবসায় পড়ি?” “ইয়ে মানে না, অনুমান করলাম আর কি।” “সরি” “উহু” “ঠিক ই ধরেছ”। “কাল আমার পদার্থ বিজ্ঞান পরীক্ষা” “পরীক্ষা দিবেন না?” “দিব” “হাসপাতাল থেকে কী পরীক্ষা দেওয়া যায় না? ” ” জ্বি, দেয়া যায়” ” কিন্তু প্রিপারেশনের ও তো একটা ব্যাপার আছে ” ” দু বছর ঘোড়ার ঘাস কাটিনি, পড়েছি।” “আগের রাতে পড়ে সব উল্টিয়ে ফেলবো, এমন তো না! ” “বাদ দাও। তুমি কার সাথে এসেছো?” “মামা এক্সিডেন্ট করেছে। তার সাথে পাহারাদার হিসেবে থাকছি আজকের রাতের জন্য।” কেয়ার টেকার ও বলা যায় ” “একশো চার নাম্বার কেবিনে আছি।” “গ্রেট” “আপনি?” “তোমাদের পাশেই একশো সাত নাম্বার কক্ষে। আমার মা অসুস্থ তো তাই বাসায় একা ভালো লাগছিলো না। মায়ের কাছে এসে পরলাম ” “আচ্ছা আমি একটু দেখে আসি মামা ঘুমিয়েছে কিনা ” আমি কেবিনের দরজা খুলে দেখলাম মামা ঘুমাচ্ছে। একটা স্ট্যান্ড এর সাথে তার পা ঝোলানো যাতে কাটা জায়গায় কোনো অসুবিধা না হয়। ঐ আপু টার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছিলো। তাই আবার ফিরে গেলাম। “কফি খাবা? ” “এতো রাতে কফি কোথায় পেলেন? ” ” বাসা থেকে ফ্লাক্সে করে নিয়ে এসেছি ” “আমি প্রচুর কফি খাই” “কফি ছাড়া আমার চলেই না ” ” খাওয়া যায়” সকালে ঘুম ভাঙতেই চোখের সামনে মামার মাথা দেখতে পারছি। “কিরে তুই এইখানে ক্যান? রাতে ঘুমাস নাই? বারান্দায়ই ঘুমায়া গেসোস? ” আমি উঠে বসলাম। নিজেকে বারান্দার মেঝে তে আবিষ্কার করলাম। আমার পাশে একটা ফ্লাক্স পড়ে আছে। এই ফ্লাক্সটাই তো রাতে ঐ আপুর হাতে ছিলো। এতো কথাবার্তা হলো কিন্তু নামটাই জিজ্ঞেস করা হলো না। যাক যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করে যাবো সমস্যা নাই। কিন্তু ঐ আপুর আজ পরীক্ষা আছে। খুব সম্ভবত দশটার দিকে। এখনই যাওয়া যাক। আমি মামা কে কেবিনে পাঠিয়ে দিয়ে একশো সাত নাম্বার কেবিনের দিকে গেলাম। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার একশ সাত নাম্বারের প কোনো কেবিন ই নেই। একশ ছয়ের পর একশ আট। নার্স কে জিজ্ঞেস করলাম, ” এক্সকিউজ মি আন্টি, ১০৭ নম্বর কেবিন টা কোথায়?” “আমাদের হসপিটালে ১০৭ নম্বরের কোনো কেবিন ই নাই ” “১০৬ এর পর ১০৮ ” “মানে?” “মানে যা শুনেছেন তাই” “আমি একটু তাড়াহুড়োয় আছি ” আজব তো একশো সাত নাই কিন্তু একশো ছয়, একশো আট ঠিক ই আছে। তাহলে কী রাতে ঐ আপু টা মিথ্যা বললো আমার সাথে। সকাল এগারোটায় রিলিজের কাগজ নিয়ে হাজির এক নার্স। সই করে আমি আর মামা বেরিয়ে গেলাম হাসপাতাল থেকে। মামার হাটতে অসুবিধে হবে তাই মামাকে হাসপাতালের ভিতরে বসিয়ে রেখে আমি বাহিরে গেলাম সিএনজি ঠিক করতে। হাসপাতালের বাইরের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি সিএনজি ঠিক করার জন্য। হাসপাতালের এক দারোয়ান আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। মানুষ চোরের দিকেও এতও সন্দেহজনক দৃষ্টি তে তাকায় না উনি যেভাবে তাকিয়েছেন। বয়স্ক লোক। মুখ ভর্তি দাড়ি। তিনি টুল থেকে উঠে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সামনে আসতেই আমি, “স্লামালেকুম চাচা ” উনি কিছু বললেন না। বয়সানুযায়ী উনি আমার নানার সমান। সুতরাং তাকে চাচা বলা যুক্তিসংগত নয়। “নানা ভালো আছেন?” এবার উনি বললেন হুম। আমি সিএনজি ঠিক করার ভানে একটু সরে এলাম। পিছন থেকে উনি বললো, “রাতে ঘুম হয়েচে? নাকি সারা রাত একশো সাত নম্বর কেবিন খুঁজেছ? মূহূর্তে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। এ কী শুনলাম! একশো সাত! আমি বয়ষ্ক লোক টার সামনে গিয়ে বললাম, একশো সাত আসলে কী নানাভাই? একশ সাত নম্বর কক্ষের রহস্য টা কী? ভদ্রলোক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। “এই হসপিটালে যে ই ভর্তি হয় যাওয়ার সময় ১০৭ নম্বর কেবিনের খোঁজ করে!” “তুমি জিজ্ঞেস কর নাই তাই বললাম। ” ” আসলে একশো সাত নাম্বার কেবিনে এক টা মেয়েলোকের মার্ডার হয়। সে বছর দুই এক আগের কথা। রাস্তা থেকে আমরা এক ধর্ষিতা মেয়ে কে উঠিয়ে এনে হাসপাতালে ভর্তি করি। একশো সাত নাম্বার কেবিনে রাখা হয়েছিলো। মেয়ে টা জিন্দা ছিল। ভর্তি করানো হলে এলাকার এক নেতার ছেলে খবর পায়। সাথে সাথে এই হাসপাতাল জিম্মি করে ঐ মেয়ের কেবিনে ঢুকে মার্ডার করে। ঐ রুম চিরতরের জন্য বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এই ঘটনার প্রমান করা যায় নি আজও। ঘটনার সব চিহ্ন উধাও। আমি আমার নিজ চোখে সব দেখেছি। কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস করে না কেউ। সবাই বলে আমি নাকি পাগল। ” “তবে সেদিনের পর থেকে ও প্রতিদিন আসে প্রতিশোধের খোঁজে। ” সব কিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। মার্ডার হতে পারে তা সত্য কিন্তু কাল রাতের কথা মনে পড়লেই গা শিহরিয়ে উঠছে। আমি আর কথা বাড়ালাম না বৃদ্ধালোক টার সাথে। একশো টাকার সিএনজি ভাড়া দুইশ টাকায় রাজি হয়ে গেলাম। এই হসপিটালে আর এক মূহূর্ত ও থাকা সম্ভব নয় । মামা কে নিয়ে সিএনজি তে উঠলাম। সিএনজি তে উঠেই মামা জিজ্ঞেসা করলো ” কিরে একশো সাত নাম্বার রুমে তো আমার কাজ ছিলো। ইয়ে মানে সকালে নার্স এসে বললো একশো সাত নাম্বার কক্ষে যেতে রক্ত পরীক্ষা করবে। ” “আমি তো খুঁজেই পেলাম না।”