নারায়ণগঞ্জ বাণী নিউজঃ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ স্বপ্নের মহাকাশ স্পর্শ করবে আজ। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টায় (বাংলাদেশ সময় ১১ মে, রাত ৩টা) বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ ফ্লোরিডার লঞ্চ প্যাড থেকে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের ‘ফ্যালকন ৯’ নামের একটি রকেটে করে মহাকাশে যাবে। এর আগে, ফ্লোরিডার স্থানীয় সময় গত শুক্রবার সন্ধ্যায় অরল্যান্ডোতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে মার্কিন এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠানটি। এবার এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের আদ্যোপান্ত।
নির্মাতা প্রতিষ্ঠান:
স্যাটেলাইটটি নির্মাণ করেছে ফ্রান্সের থ্যালাস অ্যালেনিয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠান। স্যাটেলাইটের কাঠামো তৈরি, উৎক্ষেপণ, ভূমি ও মহাকাশের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ভূ-স্তরে দুটি স্টেশন পরিচালনার দায়িত্ব এ প্রতিষ্ঠানটির।
মহাকাশে কেনা হয় কক্ষপথ:
১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি অরবিটাল স্লটে (নিরক্ষরেখায়) উড়বে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে ১৫ বছরের জন্য অরবিটাল স্লট বা নিরক্ষরেখা (১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব) লিজ নিয়েছে বাংলাদেশ। দুই কোটি ৮০ লাখ ডলার ব্যয়ে এ স্লট বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সঙ্গে রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিক ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব স্পেস কমিউনিকেশনের মধ্যে চুক্তি হয়। ইন্টারস্পুটনিকের সঙ্গে ১৫ বছরের চুক্তি হলেও এ চুক্তি তিন ধাপে ৪৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যাবে।
বিশ্বের প্রভাবশালী দেশের বাধা:
আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) বাংলাদেশকে প্রথমে নিরক্ষরেখার ১০২ ডিগ্রি স্লট বরাদ্দ দেয়। কিন্তু প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশ তাতে বাধা দেয়। দেশগুলোর আপত্তির মুখে বাংলাদেশ বিকল্প উপায় খুঁজতে থাকে। বিকল্প হিসেবে ৬৯ ডিগ্রিতে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রস্তাব দেওয়া হয় বাংলাদেশকে। কিন্তু বিকল্প প্রস্তাবেও আপত্তি তোলে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও চীন। সর্বশেষ ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রিতে (পূর্ব) স্লট বরাদ্দ পাওয়া যায়। এ স্লটটিও খালি ছিল না। স্লটটি ছিল ইন্টারস্পুটনিকের। কিন্তু অর্থের সংস্থান না হওয়ায় রাশিয়ার মহাকাশবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইন্টারস্পুটনিকের নিজস্ব দুটি স্লটের বিপরীতে (৮৪ ও ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি) একটি শর্তহীন চুক্তি করে বাংলাদেশ।
উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠান ও উৎক্ষেপণকারী রকেট
মার্কিন রকেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স এই স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নির্মাণ করে থ্যালাস অ্যালেনিয়া স্পেস গত ৩০ মার্চ একটি বিশেষ উড়োজাহাজে করে উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে এটি পৌঁছে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরালে কেনেডি স্পেস সেন্টারে স্পেসএক্সের লঞ্চ প্যাড থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিয়ে উড়বে ‘ফ্যালকন ৯’ রকেট।
অর্থায়ন:
প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ২৯০২ কোটি টাকা। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হচ্ছে ১৫৪৪ কোটি টাকা, বাকি ১৩৫৮ কোটি টাকা হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশনের (এইচএসবিসি) বিডার্স ফিনান্সিং এর মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে।
পরিচালনায় কোম্পানি গঠন
এই কৃত্রিম উপগ্রহটি উৎক্ষেপণের পর সেটি পরিচালনা, এর বিভিন্ন সুবিধার সফল ব্যবহার, বাণিজ্যিকভাবে এর ট্রান্সপন্ডার বাজারজাতকরণ ইত্যাদি কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য ইতোমধ্যে সরকারি মালিকানাধীন ‘বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। কোম্পানিতে কারিগরি লোকবল নিয়োগ এবং লোকবলকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
দেশীয় অর্থ সাশ্রয়:
বর্তমানে দেশের স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল, ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, ভি-স্যাট ও ইত্যাদি সংস্থা বিদেশি স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে। বহির্বিশ্বের বিভিন্ন স্যাটেলাইট অপারেটরের কাছ থেকে দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপন্ডার ভাড়া বাবদ প্রতি বছর প্রায় ১৪ মিলিয়ন ইউএস ডলার ব্যয় করে থাকে। অনুমোদন পাওয়া আরও স্যাটেলাইট চ্যানেলের সম্প্রচার শুরু হলে এ ভাড়া আরও বাড়বে। শুধু ব্রডকাস্টিং চাহিদার পূরণে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হলে এ অর্থ দেশেই রাখা সম্ভব হবে। তখন এই অর্থ প্রতি বছর রাজস্ব হিসেবে আয় হবে।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন:
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রান্সপন্ডার ক্যাপাসিটি থাকবে। এর মধ্যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হবে। বাকি ট্রান্সপন্ডার বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে সম্প্রচার সেবার প্রসার সহজ হবে:
প্রত্যন্ত অঞ্চলে সম্প্রচার সেবার প্রসার সহজ এবং বৈশ্বিক টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতার অবসান হবে। এছাড়া দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট।
ব্রডকাস্টিং সেবায় খরচ কমবে:
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হলে বিদেশি স্যাটেলাইটের ভাড়া ছাড়াই প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক কম মূল্যে ব্রডকাস্টিং সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। এ ছাড়া টেলিমেডিসিন, ই-লার্নিং, ই-গবেষণা, ভিডিও কনফারেন্স, প্রতিরক্ষা ও দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় জরুরি যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট।
উৎক্ষেপণ বিদেশ থেকে হলেও নিয়ন্ত্রণ করা হবে বাংলাদেশ থেকে:
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পাঠানোর কাজটি বিদেশে হলেও এটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে বাংলাদেশ থেকেই। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙামাটির বেতবুনিয়ায়। যা নিয়ন্ত্রণে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশনের যন্ত্রপাতিও আমদানি করেছে বিটিআরসি।
সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন